‘অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার ভূমি ও ভূমি-রাজস্ব’

‘অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার ভূমি ও ভূমি-রাজস্ব’

(১৭৬৫-১৭৯৩)

(দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

©️রানা©️

জেমস মিলের মতে ফিলিপ ফ্রান্সিসই বঙ্গদেশে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ প্রকৃত সংগঠক ছিলেন – “Francis may with justice be described as the original promoter of the Permanent Settlement of Bengal …”। (হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া, ৫ম খণ্ড, জেমস মিল, পৃ- ৩৩২) কিন্তু আর. বি. র‍্যামসবোথাম তাঁর সেই মতকে গ্রহণ করেন নি। তাঁর মতে ১৭৭২ সাল থেকেই বঙ্গদেশে কোম্পানির বেশ কয়েকজন কর্মচারী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষে নিজেদের মত প্রকাশ করেছিলেন। ‘আলেকজাণ্ডার ডাফ’ও তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ হিন্দুস্থান’ গ্রন্থে (১৭৭২) এবং ‘হেনরি পাত্তুলো’ তাঁর ‘এ্যান এসে অন দি কাল্টিভেশন অব দি ল্যাণ্ডস এ্যাণ্ড ইমপ্রুভমেন্টস অব দি রেভেন্যুস অব বেঙ্গল’ (১৭৭২) গ্রন্থে বাংলার ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করবার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। ডাফ মনে করেছিলেন যে, রাজস্বের স্থায়ী বন্দোবস্ত হলে কৃষির উন্নতি ঘটবে, এবং কৃষির উন্নতির সঙ্গে বাণিজ্যেরও শ্রীবৃদ্ধি হবে। মূলতঃ বাণিজ্যিক শ্রীবৃদ্ধির জন্যই ‘মার্কান্টাইলিস্ট’ (mercantilist) ডাফ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চেয়েছিলেন। অপরদিকে ‘ফিজিওক্যাট’ (Physiocrat) পাত্তুলো প্রাকৃতিক সম্পদকে আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে ধরে নিয়ে জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত চেয়েছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল যে, তার ফলে বাংলার কৃষিতে পুঁজির বিনিয়োগ বাড়বে, এবং কৃষির উন্নতির সঙ্গে শিল্পেরও প্রসার ঘটবে। তৎকালীন কোম্পানির প্রবীণ কর্মচারীদের মধ্যে ‘পি. এম. ড্যাক্রিস’ (P. M. Dacres), ‘জি. জি. ডুকারেল’ (G. G. Ducarel) ও ‘টমাস ল’ (Thomas Law) ভূমি-রাজস্বের স্থায়ী বন্দোবস্তের কথা তুলেছিলেন। লর্ড কর্ণওয়ালিশ নিজেই টমাস লকে বঙ্গদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতিষ্ঠাতা বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। (দি এগ্রেরিয়ান সিস্টেম অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এ. সি. ব্যানার্জী, পৃ- ২২৮; ‘রণজিৎ গুহ’ লিখিত ‘এ ফল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’ গ্রন্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাবক আলেকজান্ডার ডাফ, হেনরি পাত্তুলো, টমাস ল, ফিলিপ ফ্রান্সিস ও কর্ণওয়ালিশের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।) তিনি বিহারে কালেক্টর থাকাকালীন কয়েকটি পরগনায় ‘মোকরারি’ বা স্থায়ী রাজস্ব-বন্দোবস্ত গড়ে তুলেছিলেন। একথা অনস্বীকার্য যে ফিলিপ ফ্রান্সিস প্রকৃতপক্ষে ইংল্যাণ্ডে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষে জোর প্রচারকার্য চালিয়েছিলেন। তাঁর প্রচারের ফলেই ইংল্যাণ্ডের রাজনৈতিক মহলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষে অনুকূল মনোভাব গড়ে উঠেছিল। ভূমি-রাজস্ব সম্পর্কিত তাঁর বিখ্যাত মিনিটের (২২শে জানুয়ারী, ১৭৭৬ সাল) প্রভাব ইংল্যাণ্ডের প্রধান প্রধান রাষ্ট্রনেতাদের ভূমি ও রাজস্ব বন্দোবস্ত চিন্তায় নিঃসন্দেহে ছাপ ফেলেছিল। অর্থাৎ, ইংল্যাণ্ডের রাজনৈতিক মহলে জোর প্রচারকার্য চালিয়ে ফ্রান্সিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ‘পিট’, এবং বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট ‘হেনরি ডান্ডাস’ তাঁর মিনিটে অল্পবিস্তর প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে একই সঙ্গে একথাও সত্যি যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে আকারে বঙ্গদেশে চালু করা হয়েছিল, তাতে ফ্রান্সিস পরিকল্পনার অনেকগুলি প্রস্তাবই গ্রহণ করা হয়নি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে তাঁর পরিকল্পনার খালি দুটি অংশ – জমিদারেরা জমির মালিক এবং তাঁদের সঙ্গেই সরকারের স্থায়ী ভূমি-বন্দোবস্ত হওয়া উচিত – গৃহীত হয়েছিল। তাঁর বাকি সমস্ত ধরণের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। হিতবাদী দর্শনের প্রবক্তা জেমস মিল বঙ্গদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য কর্ণওয়ালিশের অভিজাততান্ত্রিক সংস্কারকে (aristocratic prejudices) দায়ী করেছিলেন। তবে এই প্রসঙ্গে ‘উইলিয়ম উইলসন হান্টার’ অন্যমত পোষণ করেছিলেন। ১৭৮৬ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর তারিখে কর্ণওয়ালিশ ভারতের গভর্ণর জেনারেল হয়ে এসেছিলেন। এর আগেই ইংল্যাণ্ডের পার্লামেন্টে ‘পিটের ইণ্ডিয়া আইন’ (১৭৮৪) পাশ হয়েছিল। সেই আইনে মধ্যপন্থা ও ন্যায়পরায়ণতার পথে (principles of moderation and justice) জমিদার বা ভূস্বামীদের সঙ্গে ভূমি-রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে স্থায়ী নিয়মরীতি (permanent rules) প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই বিলাতের ডিরেক্টর সভা ১৭৮৬ সালের ১২ই এপ্রিল তারিখে তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে ইজারা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ফ্রান্সিসের যুক্তিগুলির উদ্ধৃতি দিয়ে স্থায়ীভাবে ভূমি-রাজস্ব নির্ধারণের নির্দেশ ছিল। তাহলে উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটাই দেখা যাচ্ছে যে, কর্ণওয়ালিশ ভারতবর্ষে পদার্পণের আগেই বিলাতের কর্তৃপক্ষ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। কর্ণওয়ালিশ শুধুমাত্র সেই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করবার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৭৮৬ সালে বিলাতের ডিরেক্টর সভা কর্তৃক গৃহীত বাংলার ঐতিহাসিক ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ ছিল –

(১) স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় ভিত্তিতে ভূমি ও রাজস্ব বন্দোবস্ত গড়ে তোলা।

(২) জমিদারদের সঙ্গে ভূমি বন্দোবস্ত করা উচিত। কারণ জমিতে তাঁদের বংশানুক্রমিক অধিকার (hereditary rights) প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

(৩) ভূমি-রাজস্বের বন্দোবস্ত সহনীয় রকমের (moderate) হওয়া দরকার যাতে জমিদারদের নিরাপত্তা ও কৃষকদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য রক্ষিত হয়।

(৪) নিয়মিত ও সময়মত ভূমি-রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা। আদায়ের মাধ্যম হিসাবে বাংলার জমিদার শ্রেণীই সবচেয়ে উপযুক্ত ও বিশ্বস্ত। তাঁদের আশ্বস্ত করবার জন্য দুটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন – (ক) ভবিষ্যতে তাঁদের দেয় রাজস্বের পরিমাণ কোনো অবস্থাতেই বাড়ানো হবে না। (খ) তাঁদের জমিদারি ভোগ করবার বংশানুক্রমিক অধিকার আইনতঃ স্বীকৃত।

ডিরেক্টর সভার উপরোক্ত নির্দেশগুলি থেকে বঙ্গদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিষ্কার রূপরেখাটি পাওয়া যায়। কিন্তু ওই ব্যবস্থা কার্যকরী করা সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। ভারতে গভর্ণর জেনারেল হিসেবে লর্ড কর্ণওয়ালিশের প্রথম তিন বছরেই (১৭৮৬-১৭৮৯) বাংলার ভূমি ও রাজস্ব বন্দোবস্তের প্রশ্নে কোম্পানির প্রশাসনের উপর মহলে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছিল। সেই বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ছিলেন – কোম্পানির প্রধান সেরিস্তাদার ‘জেমস গ্রান্ট’, বোর্ড অব রেভেন্যুর প্রেসিডেন্ট ‘জন শোর’, এবং গভর্ণর জেনারেল কর্ণওয়ালিশ স্বয়ং। সেই দীর্ঘ মেয়াদী বিতর্কের চারটি অংশ ছিল –

(ক) জমির মালিকানা নিয়ে (proprietary right) গ্রান্ট ও শোরের মধ্যে বিতর্ক।

(খ) গ্রান্ট ও শোরের মধ্যে রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ (assessment), এবং রাজস্ব নির্ধারণে ভিত্তি বছর (base year) নিয়ে বিতর্ক।

(গ) জমি বন্দোবস্তের মেয়াদ (duration) নিয়ে শোর ও কর্ণওয়ালিশের মধ্যে মত পার্থক্য।

(ঘ) কর সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে জমিদারদের উপযুক্ততা নিয়ে (suitability of zamindars as the agency of collection) শোর ও কর্ণওয়ালিশের মধ্যে বিতর্ক।

বঙ্গদেশে জমির মালিকানার প্রশ্নে গ্রান্ট ও শোরের মধ্যে জোর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। শোরের মতে বাংলার জমিদারেরা জমির মালিক ছিলেন; যেহেতু তাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারি ভোগ দখল করতেন, সেহেতু তাঁরাই জমিদারি দান, বিক্রি ও বন্ধক রাখবার অধিকারী ছিলেন। সুতরাং জমিতে মালিকানা স্বত্ব (proprietary right) তাঁদেরই বলে শোর অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু জেমস গ্রান্ট শোরের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তাঁর মতে মুঘল ভূমি ব্যবস্থায় জমির প্রকৃত মালিক ছিল রাষ্ট্র; আর জমিদারেরা রাষ্ট্রের পক্ষে কর সংগ্রাহক মাত্র ছিলেন। সেজন্য তাঁরা কমিশন পেতেন। তাঁর মত ছিল যে, ভূমির কর সংগ্রাহক ভূমির মালিক কখনোই এক হতে পারেন না। শেষপর্যন্ত জমির মালিকানা বিতর্কে কর্ণওয়ালিশ জন শোরের অভিমতকেই গ্রহণ করেছিলেন। এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলার জমিদারদেরই জমির মালিক বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল, এবং ১৭৯৩ সালের ১নং রেগুলেশন অনুসারে জমিদারেরা জমির মালিক বলে সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনের দিক থেকেও ওরকম সিদ্ধান্ত সুবিধাজনক বলে (policy for administrative expediency) বিবেচিত হয়েছিল। হুইগ রাষ্ট্রাদর্শে বিশ্বাসী কর্ণওয়ালিশ সহজ ও সরল প্রশাসনের স্বার্থে, এবং সমাজে শৃঙ্খলারক্ষার জন্য কোনো সামাজিক শ্রেণীকেই জমির মালিকানা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। ভূমি-রাজস্ব চিরতরে স্থিতিশীল হলে প্রশাসনিক দায়িত্ব আরো কমে যাবে, এবং বর্ণ ও শ্রেণী ভিত্তিক সমাজে সহজে শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হবে বলেই তিনি মনে করেছিলেন। (ইংলিশ ইউটিলিটেরিয়ানস এ্যান্ড ইন্ডিয়া, এরিক স্টোকস, পৃ- ৫) নতুন বন্দোবস্তে রাজস্বের পরিমাণ ও ভিত্তি বছর ঠিক কি হবে, সেটা নিয়ে গ্রান্ট ও শোরের মধ্যে বেশ কিছু কাল ধরে বিতর্ক চলেছিল। গ্রান্ট তৎকালীন বাংলার দেওয়ানি জেলাগুলির ক্ষেত্রে ১৭৬৫ সালের রাজস্বের ভিত্তিতে বন্দোবস্ত করবার পক্ষে নিজের মত প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যে, নবাবী আমলে মীরকাশিমের সময়ে বাংলার ভূমি-রাজস্ব সর্বাধিক বাড়ানো হয়েছিল; সুতরাং ঐ ভিত্তিতে ভূমি-রাজস্বের বন্দোবস্ত করলে কোম্পানি লাভবান হবে। তবে কোম্পানির ন্যস্ত জেলাগুলির ক্ষেত্রে তাঁর প্রস্তাব অন্যরকম ছিল। তিনি মত দিয়েছিলেন যে, ওই সব অঞ্চলে স্থায়ী বন্দোবস্ত করবার আগে, রাজস্বের হস্তবুদ তৈরী করে রাজস্বের হার নির্ধারণ, এবং সেই সঙ্গে মোট জমা বাড়ানো দরকার। কারণ, কোম্পানির হাতে ন্যস্ত জেলাগুলিতে তখন দেওয়ানি জেলাগুলির তুলনায় রাজস্বের হার কম ছিল (underrated)। শোর গ্রাস্টের সেই মতের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর অভিমত ছিল যে, মুঘল ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার ধার্য রাজস্ব ও আদায়ীকৃত রাজস্বের মধ্যে ব্যবধান থাকত। (মুঘলদের ভূমি রাজস্ব আসলে জমির কর নেওয়ার ক্ষমতা নির্ধারণ (valuation) ছিল, নাকি তখন ধার্য-রাজস্ব প্রকৃতই আদায় করা হত (demand) – তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বেশ মতভেদ রয়েছে। মোরল্যাণ্ড মুঘলদের রাজস্ব হিসাবকে ‘valuation’ হিসাবে গ্রহণ করলিও, ‘Demand’ বলে স্বীকার করেননি। বিস্তারিত তথ্যের জন্য মোরল্যাণ্ডের ‘এগ্রারিয়ান সিস্টেম অব মোসলেম ইন্ডিয়া’ দ্রষ্টব্যঃ।) শোরের বক্তব্য ছিল যে, মুঘলরা কখনোই ধার্য রাজস্ব সম্পূর্ণভাবে আদায় করতেন না; মুঘল যুগে অনেকখানি রাজস্ব নানা কারণে হয় অনাদায়ী থেকে যেত, আর নয়ত মকুব হয়ে যেত। তাছাড়া মীরকাশিম আসল জমার উপরে ৭৪ লক্ষ টাকার বাড়তি আবওয়াব ধার্য করেছিলেন। ১৭৬৫ সালের জমার ভিত্তিতে স্থায়ী বন্দোবস্ত করা হলে জমিদার ও রায়তদের উপরে অস্বাভাবিক আর্থিক চাপ সৃষ্টি হবে বলে, জন শোর সেই সময়কার, অর্থাৎ ১৭৮৭ সালের আদায়ীকৃত রাজস্বের ভিত্তিতে স্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করবার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সেই প্রশ্নেও কর্ণওয়ালিশ জন শোরের অভিমতকেই সমর্থন করেছিলেন। ফলে, ১৭৮৮-৮৯ এবং ১৭৮৯-৯০ – এই দুই আর্থিক বছরের রাজস্বের ভিত্তিতে বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারিত করা হয়েছিল। বন্দোবস্তের মেয়াদ (duration) নিয়ে জন শোর ও কর্ণওয়ালিশের মধ্যে নিয়ে তৃতীয় বিতর্কটির সূত্রপাত ঘটেছিল। জন শোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরোধী ছিলেন; সেই কারণে, ১৭৯৩ সালের মার্চ মাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে চূড়ান্ত ঘোষণার আগের মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি এই দেশে ও লণ্ডনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যে, জমিদারদের সঙ্গে কিছু কালের জন্য (for a turn of years) ভূমি বন্দোবস্ত করা সম্ভব হলেও, কোনমতেই স্থায়ী বন্দোবস্ত করা সম্ভব নয়। তাঁর আপত্তির পেছনে প্রধান যুক্তিগুলি ছিল – (ক) স্থায়ী বন্দোবস্ত হলে ভবিষ্যতে লোক সংখ্যা ও চাষ বাড়লেও সরকার জমির আয় থেকে বঞ্চিত হবে। (খ) ভূমি ও রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে কোম্পানির কর্মচারীদের অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। (গ) রায়তদের অধিকার, জমিদারির সীমানা, নিষ্কর সম্পত্তি, গোচারণ ভূমি ও পতিত জমির হিসাব অসম্পূর্ণ থাকবে। ফলে ওই অবস্থায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলে ভূমি ও রাজস্ব ব্যবস্থায় নানারকম জটিলতা দেখা দেবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রশ্নে কর্ণওয়ালিশ জন শোরের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তাঁর মত ছিল যে, বিগত কুড়ি বছরে (১৭৬৯-১৭৮৯) কোম্পানি বাংলার ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (১৭৭০) পরে বাংলার এক তৃতীয়াংশ জমি অনাবাদের জন্য জঙ্গলে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তখন ঐ সব জমিকে চাষের আওতায় আনবার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন যে, অন্যথায় সামগ্রিকভাবে লোকসানের সম্ভাবনা বেশী; কারণ, কৃষির উন্নতির উপরেই বাংলার আর্থিক অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। কর্ণওয়ালিশ ও শোরের মধ্যে ভূমি-রাজস্বের সংগ্রাহক হিসেবে জমিদারদের উপযুক্ততা সম্পর্কে চতুর্থ বিতর্কটি দেখা দিয়েছিল। প্রস্তাবিত ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থায় জমিদারদের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তখন মিতব্যয়ী জমিদার মাত্রেই সরকারি অর্থের বিচক্ষণ ‘অছি’ (economical landlords and prudent trustees of public interest) বলে পরিগণিত হতেন। ফলে জমিতে স্থায়ী অধিকার হাতে আসবার পরে তাঁরা কৃষির পুনর্গঠনে যত্নবান হবেন বলে কর্ণওয়ালিশ মত প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর আশা ছিল যে, এর ফলে বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় রকমের রূপান্তর ঘটবে। কিন্তু জন শোর জমিদারদের দক্ষতা ও ক্ষমতা সম্পর্কে গভীর সন্দেহ পোষণ করতেন। এই প্রসঙ্গে ১৭৮৯ সালের জুন মাসে তিনি লিখেছিলেন, “জমিদারদের মধ্যে খুব কম ব্যক্তিই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি পরিচালনায় যথার্থরূপে যোগ্য। সাধারণভাবে বলতে গেলে তাঁরা একাজের জন্যে যথার্থ শিক্ষা পাননি। জমিদারি পরিচালনায় সাধারণ কাজের বিভিন্ন দিক, এবং পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁরা অজ্ঞ ও কাজে অমনোযোগী, এমনকি যখন তাঁদের নিজেদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখনো তাঁরা জমিদারি পরিচালনার মানসিকতা বা সাহস দেখাতে পারেন না।” জন শোর তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকেই তৎকালীন বাংলার জমিদারদের দক্ষতা ও ক্ষমতা সম্পর্কে ওরকম কঠোর বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তবে বাংলার জমিদারদের সম্পর্কে কর্ণওয়ালিশের ধারণা অন্যরকম ছিল। এই প্রসঙ্গে ১৭৯০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “জমিদারদের বর্তমান ত্রুটির জন্যে এদেশের প্রচলিত কর সংগ্রহ পদ্ধতিই দায়ী।” অর্থাৎ, এদেশের প্রচলিত ইজারা ব্যবস্থার জন্যই (farming system) জমিদারদের অদক্ষতা ও অপদার্থতাকে তিনি দায়ী করেছিলেন। প্রচলিত ব্যবস্থায় সরকারি তত্ত্বাবধানে জমিদারদের নাবালক করে রাখা হয়েছিল। জমিতে কোন স্থায়ী অধিকার না থাকবার জন্য তাঁরা জমি বন্ধক রেখে ধার নিতে পারতেন না, বা সরকারের বিনা অনুমতিতে জমিদারি বিক্রি করবার অধিকারও তাঁদের হাতে ছিল না। ফলে তাঁরা তাঁদের বিলাস, ব্যসন ও অপদার্থতার জন্য ফলভোগ করেননি। কর্ণওয়ালিশ জানতেন যে, আগের ব্যবস্থা চালু থাকলে জমিদারদের ত্রুটিগুলিও থেকে যাবে। তাই তিনি আইন করে জমিদারদের যেমন পরিশ্রম ও মিতব্যয়িতার ফলভোগ করতে দিতে চেয়েছিলেন, তেমনি একই সঙ্গে তাঁদের অমিতব্যয়িতা ও অলসতার ফলও ভোগ করাতে চেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে হয় তাঁরা যোগ্যতা ও মিতব্যয়িতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করে টিকে থাকতেন, অথবা অমিতব্যয়িতা ও অপদার্থতার প্রতিফল হিসেবে জমিদারি বিক্রি করতে বাধ্য হতেন। তিনি চেয়েছিলেন যে, জমিদারির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নতুন যাঁরা আসবেন তাঁরা চাষ আবাদ বাড়িয়ে পরিশ্রম ও মিতব্যয়িতার ফলভোগ করবেন। অপদার্থতা ও অলসতায় বংশপরম্পরায় জমিদারি ভোগ দখল করানো কর্ণওয়ালিশের অভিপ্রেত ছিল না। তাঁর প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় জমিদারদের দায়িত্বও অনেকখানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের উপরে ন্যস্ত পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব, বিচার করবার অধিকার ও একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ শুল্ক সংগ্রহের অধিকারও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। কর্ণওয়ালিশ ব্যবস্থায় – “যে ব্যক্তি চাষবাস বাড়াবে, রায়তদের রক্ষা করবে ও সময়মত সরকারি রাজস্ব জমা দেবে সেই জমিদার”। ওই ব্যবস্থায় কে বা কোন বিশেষ ব্যক্তি জমিদারির মালিক হবেন, সেটা নিয়ে সরকারের কোন মাথাব্যথা ছিল না। কর্ণওয়ালিশ দক্ষ, পরিশ্রমী, মিতব্যয়ী ও বিবেচক জমিদার চেয়েছিলেন। জন শোর কর্ণওয়ালিশের মত সেই নতুন পরিস্থিতিতে বাংলার জমিদারদের চরিত্রগত পরিবর্তনের উপরে কোন আস্থা রাখতে পারেননি। তিনি মনে করেছিলেন যে, সেই নতুন পরিস্থিতিতে জমিদারেরা নতুন করে কাজ করবেন না, এবং কর্ণওয়ালিশ কল্পিত – “মিতব্যয়ী জমিদার ও সরকারি অর্থের বিচক্ষণ অছিও হবেন না।” সেক্ষেত্রে জন শোরের অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগের বাংলার ক্ষয়িষ্ণু জমিদারশ্রেণী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরেও বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে যথার্থ শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে কাজ করতে পারেনি।

১৭৮৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কর্ণওয়ালিশ জেলার কালেক্টরদের কাছে কতগুলি জরুরি তথ্য সংগ্রহের জন্য নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। কালেক্টরদের কাছে তাঁর জ্ঞাতব্য বিষয় ছিল তিনটি – (ক) জেলার জমা বা রাজস্বের পরিমাণ, (খ) প্রকৃত জমিদার বা ইজারাদারদের নাম যাঁদের সঙ্গে সরকার ভূমি বন্দোবস্ত করবেন, (গ) রায়তদের স্বার্থরক্ষামূলক সুপারিশ ও সেই সঙ্গে রায়তদের মধ্যে ষড়যন্ত্র করে জমিদারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা। কালেক্টরদের সংগৃহীত তথ্য, এবং বোর্ড অফ রেভেন্যুর সুপারিশসহ ভূমি-বন্দোবস্ত সম্পর্কিত কাগজপত্র সপারিষদ গভর্ণর-জেনারেল ১৭৮৮ সালের নভেম্বর মাসে হাতে পেয়েছিলেন। পরের বছরের সেপ্টেম্বর মাসে (১৭৮৯ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে) বিহার, এবং ১৭৯০ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারী তারিখে বঙ্গদেশে অস্থায়ীভাবে কর্ণওয়ালিশ ‘দশশালা বন্দোবস্ত’ (ten years settlement) চালু করেছিলেন। সেই বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার জমিদার, ইজারাদার, তালুকদার ও অন্যান্য ভূস্বামীদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্ত করা হয়েছিল (for a period of ten years certain with a view to permanency)। দশশালা বন্দোবস্ত চালু করবার সময়ে জমিদারদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে, ডিরেক্টর সভার অনুমোদন পাওয়া গেলে দশশালা বন্দোবস্তকেই স্থায়ী বলে ঘোষণা করা হবে। উক্ত ব্যবস্থায় বাংলার মোট ভূমি-রাজস্বের পরিমাণ ২,১৮,২৯,৪৫৯ টাকা; এবং বিহারের মোট ভূমি-রাজস্বের পরিমাণ ২,৬৮,০০,৯৮৯ টাকা বলে ধার্য করা হয়েছিল। তখন ঠিক হয়েছিল যে, ওই ধার্য রাজস্বের দশ শতাংশ জমিদারেরা তাঁদের পারিশ্রমিক হিসেবে পাবেন, আর বাকি নব্বই শতাংশ সরকারি কোষাগারে জমা পড়বে। কিন্তু ফিফথ রিপোর্ট রচয়িতাদের মতে সেই নতুন ভূমি বন্দোবস্তে রাষ্ট্র মোট রাজস্বের এগারো ভাগের দশ ভাগ পেয়েছিল, আর বাকি একভাগ পেয়েছিলেন জমিদারেরা। জন শোরের হিসাব মত জমির উৎপাদনের ৪৫% রাষ্ট্র, ১৫% জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা, এবং ৪০% কৃষকেরা পেয়েছিলেন। সেই নতুন ব্যবস্থায় জমিদারদের অভ্যন্তরীণ শুল্ক (সায়ের) আদায়ের কোন অধিকার ছিল না। এরপরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষে কর্ণওয়ালিশের সুপারিশসহ দশশালা বন্দোবস্তের রিপোর্ট বিলাতে ডিরেক্টর সভার কাছে গিয়েছিল। ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী পিট, এবং বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট হেনরী ডাণ্ডাস ভারত বিষয়ে অভিজ্ঞ চার্লস গ্রান্ট, এবং জন শোরের সঙ্গে সেই বিষয়ে পরামর্শ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অনুকূলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও শেষ মুহুর্তেও শোর কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৭৯২ সালের ২৯শে আগস্ট তারিখে ডিরেক্টর সভা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা করবার জন্য গভর্ণর জেনারেলকে নির্দেশ পাঠিয়েছিল। ঠিক পরের বছরের ২২শে মার্চ (২২শে মার্চ, ১৭৯৩ সাল) গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিশ দশশালা বন্দোবস্তকেই চিরস্থায়ী বলে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর সেই ঘোষণার বিষয়গুলি নিম্নরূপ ছিল –

(১) বাংলার জমিদার, স্বাধীন তালুকদার ও জমির অন্যান্য মালিকদের দশশালা বন্দোবস্তের রাজস্বের ভিত্তিতে উত্তরাধিকারসূত্রে চিরকাল জমিদারি ভোগ করবার অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল।

(২) ভবিষ্যতে খরা, বন্যা বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাজস্ব মকুবের আবেদন অগ্রাহ্য হবে বলে জানানো হয়েছিল।

(৩) নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হলে জমিদারির সমস্তটাই বা একাংশ বিক্রি করে সরকারি পাওনা মেটানো হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। এর ফলে বস্তুতঃ জমিদারের জমিদারিই সরকারি রাজস্বের জামিন বলে বিবেচিত হয়েছিল।

(৪) ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে সরকার অধীনস্থ তালুকদার, রায়ত বা কৃষকের স্বার্থরক্ষামূলক ও মঙ্গলকর ব্যবস্থা নিতে পারবেন বলে জানানো হয়েছিল। অধীনস্থ তালুকদার ও রায়তদের স্বার্থরক্ষাকল্পে কর্ণওয়ালিশ নির্দেশ দিয়েছিলেন (৮নং রেগুলেশন, ১৭৯৩ সাল) যে, এর আগে যাঁরা বারো বছরের বেশি সময় ধরে নির্দিষ্ট হারে ভূমি-রাজস্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কোনো ভাবেই আর ভূমি-রাজস্ব বাড়ানো চলবে না। অন্যদের ক্ষেত্রে ভূমি-রাজস্বের হার পরগনা-হার (pargana rate) অনুযায়ী ধার্য করা হবে বলে ঠিক করা হয়েছিল। কর্ণওয়ালিশ মনে করেছিলেন যে, জমিদার ও রায়তের মধ্যে ঘোষিত লিজের ব্যবস্থা (scheme of declaratory leases) সরকার ও জমিদারের মধ্যে অপরিবর্তনীয় ভূমিকরের রূপ নেবে, এবং তাতে কৃষকের নিরাপত্তা সূচিত হবে।

(৫) জমিদারেরা অভ্যন্তরীণ শুল্ক আদায়ের অধিকার পাবেন না বলে জানানো হয়েছিল। এছাড়া বিচার বা পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব থেকেও তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।

(৬) জমিদারেরা ইচ্ছামত জমিদারি বিক্রি, বন্ধক, দান বা অন্যভাবে হস্তান্তর করতে পারবেন বলে জানানো হয়েছিল। সেই ব্যাপারে সরকারি অনুমোদনের কোন প্রয়োজন ছিল না।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অনুকূলে কর্ণওয়ালিশের উত্থাপিত যুক্তিগুলি ছিল –

(১) উক্ত ব্যবস্থার ফলে জমিতে স্থায়ী স্বার্থ তৈরি হলে জমি ও চাষের উন্নতি ঘটবে। ফলে পতিত ও অনাবাদী জমিও চাষের আওতায় চলে আসবে। জমির আয় থেকেই জমিদারেরা জমিতে বাঁধ দেওয়া ও জলসেচের জন্য রিজারভার (reservoir) তৈরিতে এগিয়ে যাবেন। ধীরে ধীরে লোকসংখ্যা বাড়বে, এবং ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী প্রভাব থেকে বঙ্গদেশ ও জনগণ মুক্তি পাবে।

(২) যেহেতু বাংলার কৃষি ও শিল্প অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সেহেতু কৃষির উন্নতির উপরে শিল্প, এবং সেই সঙ্গে দেশের আর্থিক অগ্রগতি নির্ভরশীল। যদি কৃষির উন্নতি ঘটানো সম্ভব না হয়, তাহলে কৃষি ও শিল্প – বাংলার সম্পদের এই দুই প্রধান উৎসই ধ্বংস হয়ে যাবে। জমিদারেরা জমির মালিক হিসেবে কৃষির উন্নতিতে মনোযোগী হবেন।

(৩) জমিদারি স্থায়ী সম্পত্তির মর্যাদা পেলে অনেকে জমিতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবেন। এই প্রসঙ্গে কর্ণওয়ালিশ ১৭৯০ সালের এপ্রিল মাসে ডিরেক্টর সভাকে লিখেছিলেন যে, শুধুমাত্র ব্যবসা ও সুদের কারবারে রত কলকাতার ধনী বণিক ও মহাজনেরা অজ্ঞাতপূর্ব সেই স্থায়ী সম্পত্তিতে নিজেদের অর্থ বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন, আর সেখান থেকে লাভের অঙ্কটা সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হতে পারলে তাঁরা জমির দিকে আকৃষ্টও হবেন।

(৪) কর্ণওয়ালিশ আশা করেছিলেন যে, তৎকালীন বাংলার জমিদার শ্রেণী সমাজে একটি স্থিতিশীল শক্তি (stabilising force) হিসেবে কাজ করবে। গ্রামে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট, উৎসব প্রভৃতির ব্যবস্থা করে জমিদারেরা মৃতপ্রায় গ্রাম বাংলায় আবার প্রাণের সঞ্চার করতে সক্ষম হবেন।

(৫) উক্ত সময়ে কোম্পানির নিয়মিতভাবে প্রচুর টাকার প্রয়োজন ছিল। তখন ক্রমবর্ধমান সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক ব্যয়, রপ্তানি বাণিজ্যে বিনিয়োগ (বঙ্গদেশ থেকে অগ্রিম দাদন দিয়ে পণ্য কিনে ইউরোপে পাঠানোর ব্যবস্থা), মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সির ঘাটতি মেটানো, এবং কোম্পানির চীনদেশে বাণিজ্যের জন্য মূলধনের যোগান বঙ্গদেশ থেকেই করা হত। উপরোক্ত ক্ষেত্রে জটিলতা ও অসুবিধা দূর করবার জন্যই নিয়মিত রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করবার উদ্দেশ্যেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করা হয়েছিল।

(৬) কর্ণওয়ালিশ আশা করেছিলেন যে, সেই নয়া জমিদারতন্ত্র কোম্পানির সাম্রাজ্যের শক্তিশালী স্তম্ভ হয়ে উঠবে; অর্থাৎ কোম্পানির রাজনৈতিক বন্ধু হিসেবে (political ally) অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা বৈদেশিক আক্রমণকালে কায়েমী স্বার্থপুষ্ট বাংলার জমিদার শ্রেণী বৃটিশ শাসনকে রক্ষা করতে এগিয়ে যাবে। তখন বৃটিশ শাসনের স্থায়িত্বের উপরেই জমিদারদের ভাগ্য নির্ভরশীল ছিল। ভারত থেকে তখনও মারাঠা আফগান, শিখ ও ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান ঘটেনি। তাই একটি শক্তিশালী সামাজিক গোষ্ঠীকে কোম্পানির শাসনের সহায়ক শ্রেনীরূপে পাওয়াও কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বলা যেতে পারে।

(৭) এর আগে কোম্পানির কর্মচারীরা ভূমি-রাজস্ব নিয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকবার ফলে ক্রমবর্ধমান প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না। ভূমি-রাজস্বের স্থায়ী বন্দোবস্ত হলে কোম্পানির কর্মচারীরা অন্য বিভাগের উন্নয়নমূলক পরিকল্পনায় মনঃসংযোগ করতে পারবেন বলে কর্ণওয়ালিশ মনে করেছিলেন। তাছাড়াও তাঁর মত ছিল যে, তাতে প্রশাসন ও বিচার বিভাগের কাজকর্মে উন্নতি সাধন করা সম্ভব হবে।

(৮) ভূমি-রাজস্ব চিরতরে স্থায়ী বলে ঘোষণা করলে রাষ্ট্রের যে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল, সেটা সাধারণ আর্থিক উন্নতি ও বাণিজ্যিক বিকাশের ফলে পুষিয়ে যাবে বলে কর্নওয়ালিশের মনে হয়েছিল। তিনি ভূমি-রাজস্ব খাতে ক্ষতি বাণিজ্যিক শুল্ক ও অন্যান্য কর স্থাপন করে নেওয়া সম্ভব বলে মনে করেছিলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যে ত্রুটিগুলি ধরা পড়েছিল, সেগুলি ছিল – প্রথমতঃ, রাষ্ট্র জমির মালিকানা (proprietary right) ত্যাগ করবার ফলে জমি থেকে রাষ্ট্রের আয় চিরকালের জন্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। ক্রমে লোক সংখ্যা বৃদ্ধি এবং দেশী কুটির ও হস্ত শিল্প ধংস হওয়ার ফলে জমির উপরে অস্বাভাবিক চাপের সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জমির উৎপাদন ও দাম কয়েকগুণ বাড়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র সেই বর্ধিত আয়ের অংশ পায়নি। জমিদারেরা সেই বর্ধিত ও অনর্জিত আয়ের (unearned income) সবটুকই ভোগ করবার অধিকার পেয়েছিলেন। জমি থেকে বর্ধিত আয় দেশের উন্নয়নমূলক কাজকর্মে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়তঃ, রাষ্ট্রের ভূমি-রাজস্ব থেকে আয় চিরস্থায়ী হওয়ার জন্য আর্থিক প্রয়োজনে পরবর্তীকালে নতুন কর বা শুল্ক বসিয়ে রাষ্ট্রকে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। জমিদারেরা জমি থেকে অনার্জিত আয় ভোগ করতে শুরু করেছিলেন, আর দেশের আপামর জনসাধারণকে বাড়তি কর বহন করতে হয়েছিল। এর উপরে প্রশাসনের বর্ধিত ব্যয় মেটাতে গিয়ে রাষ্ট্রকে টাকা ধার নিতে হয়েছিল (public debt), আর ধার করা সেই মোটা টাকার সুদ ভারতবাসীকেই যোগান দিতে হয়েছিল। এছাড়া আর্থিক অসুবিধার জন্য সরকার ক্ষতিকর অভ্যন্তরীণ শুষ্ক ও একচেটিয়া ব্যবসাকেও পুরোপুরিভাবে তুলে দিতে পারেনি। (ট্রেড এ্যান্ড ফিনান্স ইন দি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি: ১৭৯৩-১৮৩৩, অমলেশ ত্রিপাঠী, পৃ- ২৫৯) তৃতীয়তঃ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বহু প্রকার মধ্যস্বত্বভোগীর আবির্ভাব ঘটেছিল। জমিদারেরা তাঁদের জমিদারি খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করে পত্তনি দিতে শুরু করেছিলেন। (বর্ধমানের জমিদারেরা প্রথম পত্তনি দিতে শুরু করেছিলেন।) সেই পত্তনিদাররা আবার দূর পত্তনি দিতে শুরু করেছিলেন, এবং দূর পত্তনিদারেরা আবার দূর দূর পত্তনি দিয়েছিলেন। ওই ভাবে জমিতে নানা ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীর আবির্ভাব ঘটেছিল। সেই ব্যবস্থা আস্তে আস্তে প্রসারিত হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে অবশেষে নিজের চরম রূপ ধারণ করেছিল। তখন বঙ্গদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে রাষ্ট্র ও কৃষকের মধ্যে কমপক্ষে পঞ্চাশজন মধ্যস্বত্বভোগীর (intermediaries) সন্ধানও পাওয়া গিয়েছিল। জমিতে মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফল হয়েছিল প্রকৃত কৃষকের উপর করের চাপ বৃদ্ধি। কালক্রমে বহুস্তর বিশিষ্ট (rack renting) নানা প্রকার করের বোঝা বাংলার রায়তদের কাঁধে চেপে বসেছিল। চতুর্থতঃ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদার ও রায়তের মধ্যে সম্পর্ককে কখনোই সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। জমিদারেরা সরকারের কাছ থেকে রায়তের অধিকার ও ভূমি রাজস্ব নির্দিষ্ট করে লিখিত পাট্টায় (pattah) দেওয়ার নির্দেশ পেলেও, জমিদারেরা সেই নির্দেশ পালন করেন নি, আর রায়তরাও পাট্টা নিতে কোন উৎসাহ দেখান নি। এর ফলে জমিতে রায়তদের মালিকানা অস্বীকৃত থেকে গিয়েছিল। রায়তদের মত মাজকুরি তালুকদাররাও জমিতে তাঁদের মালিকানা হারিয়েছিলেন। (তৎকালীন বাংলার জমিদারদের তিনভাগে ভাগ করা হয়েছিল: (ক) বৃহৎ জমিদার – রাজশাহী, বর্ধমান, দিনাজপুর, নদীয়া; (খ) মধ্যম জমিদার – বীরভূম, বিষ্ণপুর, যশোহর, রকনপুর, মামুদশাহী, ভদ্রাকপুর, আমিনপুর ইত্যাদি; (গ) অসংখ্য ছোট জমিদার ও তালুকদার। তালুকদারেরা আবার দু’ভাগে বিভক্ত ছিলেন। যাঁরা সরাসরি সরকারি রাজকোষে রাজস্ব জমা দিতেন, তাঁদের বলা হত ‘হুজুরি তালুকদার’। আর যাঁরা বৃহৎ জমিদারদের মাধ্যমে খাজনা জমা দিতেন, তাঁদের বলা হত ‘মাজকুরি তালুকদার’। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে দ্বিতীয় শ্রেণীর তালুকদারেরা জমির মালিকানা হারিয়েছিলেন। দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ২য় খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ: ১২০-১৩১) তৎকালীন ভূমি-ব্যবস্থায় তালুকদারেরা জমিদারদের সঙ্গে নিঃসন্দেহে সমমালিকানা (co-owners of the soil) ভোগ করতেন। “জমিদারদের ভূস্বামী করে দিয়ে, এবং কৃষকদের তাঁদের অধীনস্থ প্ৰজা করে দিয়ে ইংরেজরাই প্রথম পরিপূর্ণভাবে ভূমি ব্যবস্থায় সামন্ততন্ত্রের পত্তন করেছিলেন। প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘রায়তের কথা’য় দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘যে সময়ে ফরাসী কৃষক সামন্ততন্ত্রের অবসান করে জমির মালিক হলো – সেই সময়ে বাংলার কৃষক তাঁদের দীর্ঘ দিনের অধিকার হারাল।’ …” (বাংলার ভূমি ব্যবস্থার রূপরেখা, বিনয় চৌধুরী, পৃ- ১৫) পঞ্চমতঃ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্যতম প্রধান ত্রুটি ছিল ‘অনুপস্থিত জমিদার’ (absentee landlordism)। কর্নওয়ালিশের আশামত জমিদারেরা গ্রাম বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন নি। বরং নায়েব গোমস্তাদের উপরে জমিদারি পরিচালনার ভার দিয়ে তাঁরা কলকাতায় গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। এর ফলে গ্রামবাংলার সমাজ জীবনে স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে জমিদারদের অনুপস্থিতির সুযোগে জমিদারদের আমলারা নানাপ্রকার অত্যাচার, জুলুম ও শোষণের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। ষষ্ঠতঃ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পরবর্তী প্রথম দুই দশকে বাংলার অনেকগুলি ঐতিহ্যশালী জমিদার পরিবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তখন কঠোর ‘সূর্যাস্ত আইন’ প্রয়োগ করে সরকারি রাজস্ব আদায় করা হত। ফলে নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের আগে সরকারি রাজস্ব জমা দিতে না পারলে জমিদারি নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হত। বাংলার জমিদারেরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে প্রথম কয়েক বছর সময়মত সেই রাজস্ব যোগাড় করতে পারেন নি। ওই সময়ে জমিদারির দাম ও সুদের হারও অনেক বেশি ছিল। ফলে তাঁদের অনেককে প্রথম বছরে বন্দীশালায় থাকতে হয়েছিল, এবং অনেকের জমিদারি নিলাম করে দেওয়া হয়েছিল। পরে রায়তের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে জমিদারকে রাজস্ব আদায়ের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। তাতে জমিদারদের পক্ষে রাজস্ব আদায়ের খানিকটা সুবিধা হয়েছিল। (১৭৯৩ সালে গভর্ণর জেনারেলের ১৭ (২) রেগুলেশন, এবং ১৭৯৯ সালের ৭নং রেগুলেশন দ্বারা জমিদারদের রায়তের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করবার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। এরপরে ১৮১২ সালের ৫নং রেগুলেশনে জমিদারদের ক্রোক করবার ক্ষমতার উপরে বিধি নিষেধ আরোপিত করা হয়েছিল।) সমপ্তমতঃ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বঙ্গদেশে এমন অনেক নতুন জমিদারের সৃষ্টি হয়েছিল, আগে যাঁদের ভূমি ও রাজস্বের সঙ্গে কোনো ধরণের সম্পর্ক ছিল না। তাঁরা ছিলেন কলকাতার নব্য ধনী, মহাজন ও বণিক মনোবৃত্তিধারী ফাটকাবাজ জমিদার। তখন ঐতিহ্য বা প্রচলিত রীতিনীতি নয়, আইন ও চুক্তিই বাংলার সেই নয়া জমিদারতন্ত্র ও রায়তের মধ্যে সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করত। এর ফলে গ্রামবাংলার জমি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা অনেক পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। জেমস মিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার ছাড়া ভূমির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য সমস্ত শ্রেণীর স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর মতে ওরকম ভূমি ব্যবস্থায় আর্থিক ও সামাজিক অগ্রগতি ব্যাহত হতে বাধ্য থাকে। অপরদিকে ‘রমেশচন্দ্র দত্ত’ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে ভারতে বৃটিশ শাসনের সবচেয়ে বড় অবদান বলে উল্লেখ করেছিলেন। (ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, ১ম খণ্ড, রমেশচন্দ্র দত্ত, পৃ: ৯৪-৯৫) তাঁর মতে ওই সময়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বৃটিশ প্রবর্তিত ভূমি বন্দোবস্তের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বঙ্গদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনেক ভাল ব্যবস্থা হয়েছিল। তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যে দুটি সুবিধাজনক দিক দেখিয়েছিলেন, সেগুলি হল – (ক) সরকারি রাজস্ব স্থায়ীভাবে নির্ধারিত হওয়ার জন্য সরকারের প্রয়োজনে ভূমি রাজস্ব বাড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। (খ) তুলনামূলকভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ভূমি-রাজস্বের হার কম ছিল। সেজন্য বাংলার সঞ্চয় বেশি, দুর্ভিক্ষ কম, এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে তুলনায় বাংলার কৃষকরা অপেক্ষাকৃত বেশি স্বচ্ছল হতে পেরেছিলেন। রমেশচন্দ্রের ধারণা হয়েছিল যে, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলার কৃষির সঙ্গে যুক্ত সর্বশ্রেণীর মানুষ (the whole agricultural community) উপকৃত হয়েছেন।”

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্ববর্তী ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনায় (১৭৬৫-১৭৯৩) ওই ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে উন্নত ধরনের ছিল। তাতে বাংলার কৃষি অর্থনীতিতে খানিকটা হলেও স্থিতিশীলতা এসেছিল। তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলার সব শ্রেণীর কৃষকের উপকার ও সমৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল – রমেশচন্দ্রের এই মন্তব্যকে কোনভাবেই স্বীকার করে নেওয়া যায় না। জমিদার ও রায়তের সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্থায়ী আইনগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার ফলে বাংলার জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বয়ন শিল্পের ধবংসের সঙ্গে সঙ্গে জমিদার রায়তকে তাঁর জমির নিরাপত্তা বা ন্যায্য রাজস্ব হার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। নতুন ব্যবস্থায় সরকারি রাজস্ব মকুবের কোনো ব্যবস্থা না থাকবার ফলে জমিদারও দুঃসময়ে রায়তের দেয় খাজনা মকুব করতে পারেন নি। জমিদারির নিশ্চিত ও নিরাপদ আয় বাংলার শিল্প ও বাণিজ্য থেকে মূলধন সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে মার্কস তাঁর ‘ক্যাপিটালের’ তৃতীয় খণ্ডে মন্তব্য করেছিলেন, “ভারতের ইংরেজ শাসনের ইতিহাসেই কেবলমাত্র দেখা যায় সে দেশের অর্থব্যবস্থায় অনেকগুলি ব্যর্থ, এবং নিতান্ত অবাস্তব ও কুখ্যাত পরীক্ষা চালানো হয়েছে। বাংলা দেশে তাঁরা ব্যাপকভাবে বিলাতী ধরনের বৃহদায়তন জমিদারীর অপকৃষ্ট নকল সৃষ্টি করেছে।” (বাংলার ভূমি ব্যবস্থার রূপরেখা, বিনয় চৌধুরী, পৃ- ১৫) তবে উক্ত ধরনের বহু ত্রুটি সত্ত্বেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার একটি বিশেষ সামাজিক শ্রেণীর হাতে কিছু বাড়তি টাকার যোগান দিতে পেরেছিল, যা বঙ্গদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আন্দোলন, শিক্ষা, শিল্প, সঙ্গীত ও সংস্কৃতি চর্চায় সহায়ক হয়েছিল। তখন বিদেশী শাসকের হাতে যদি সেই উদ্বৃত্ত ভূমি-রাজস্ব যেত, তাহলে বাঙালীদের ওই প্রয়োজনীয় কাজগুলি আর কখনোই সম্পন্ন হত কিনা, সেটা যথেষ্ট সন্দেহের বিষয়। (এ কনসাইজ হিস্ট্রি অব দি ইন্ডিয়ান ইকনমি: ১৭৫০-১৯৫০, ধীরেশ ভট্টাচার্য্য, পৃ- ৪০)

দেওয়ানি থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষপর্যন্ত (১৭৬৫-১৮০০) বাংলার ভূমি-রাজস্বের পরিমান নিম্নরূপ ছিল –

১৭৬৫-৬৬ সাল: ১,৬০,২৯,০১১ টাকা; ১৭৬৮-৬৯: ১,৬৫,৯৯,০৬৫; ১৭৬৯-৭০: ২,৩৩,৪৪,৮৪৭; ১৭৭০-৭১: ২,৪০,৮৪,৫৫৯; ১৭৭১-৭২: ২,৫৫,১২,০৬৯; ১৭৭২-৭৩: ২,২২,৭৮,৩৫৬; ১৭৭৩-৭৪: ২,৩০,৭৬,৪১৫; ১৭৭৪-৭৫: ২,৬৬,১৬,৯৮৩; ১৭৭৫-৭৬: ২,৬৭,৫৩,৩০১; ১৭৭৬-৭৭: ২,৬৯,০১,০৩৩; ১৭৭৭-৭৮: ২,৫৭,৬১,৭১৬; ১৭৭৮-৭৯: ২,৫৩,৮২,৮৭৩; ১৭৭৯-৮০: ২,৫২,৬০,৬৬৪; ১৭৮০-৮১: ২,৫৫,১২,০৮০; ১৭৮১-৮২: ২,৭৯,০৫,৮৫০; ১৭৮২-৮৩: ২,৮০,২৫,৪৬৫; ১৭৮৩-৮৪: ২,৭২,৬৫,৪১৪; ১৭৯০-৯১: ২,৬৮,০০,৯৮৯; ১৭৯৩: ২,৬৮,০০,৯৮৯; ১৭৯৩-৯৪: ৩,১৭,৭০,২৮০; ১৭৯৪-৯৫: ৩,২৩,৫২,৫৯০; ১৭৯৫-৯৬: ৩,১৩,০৬,৯৭०; ১৭৯৬-৯৭: ৩,১১,৮৫,৫৬০; ১৭৯৭-৯৮: ৩,০৯,৭৪,৪৩০; ১৭৯৮-৯৯: ৩,০৭,২৭,৪৩০; ১৭৯৯-১৮০০: ৩,২১,৩২,৩০০।

(সূত্র: দি ফিফথ রিপোর্ট: ১৮১২, ১ম খণ্ড, ডব্লিউ. এ. কে. ফারমিংগার সম্পাদিত, পৃ- ১৮; দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ২য় খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ- ১০৫; ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, ১ম খণ্ড, রমেশচন্দ্র দত্ত, পৃ: ৩৯৯-৪০০। রমেশচন্দ্র দত্তের গ্রন্থে বাংলার ভূমি-রাজস্বের হিসাব পাউন্ডে দেওয়া রয়েছে। এখানে তখনকার হিসেবে এক পাউন্ড সমান দশ টাকা ধরে নিয়ে ভূমি-রাজস্বের হিসাবকে টাকায় আনা হয়েছে।)

(সমাপ্ত)

©️রানা©️

(তথ্যসূত্র:

১- দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ২য় খণ্ড, এন. কে. সিংহ।

২- ভেরেলেস্টস ল ইন ইন্ডিয়া, নন্দলাল চ্যাটার্জী।

৩- দি ট্রানজিশন ইন বেঙ্গল: ১৭৫৬-১৭৭৫, আবদুল মজিদ খাঁ।

৪- স্টাডিজ ইন দ্য ল্যান্ড রেভেন্যু হিস্ট্রি অব বেঙ্গল: ১৭৬৯-৮৭, আর. বি. র‍্যামসবোথাম।

৫- দি এগ্রেরিয়ান সিস্টেম অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এ. সি. ব্যানার্জী।

৬- দি ফিফথ রিপোর্ট: ১৮১২, ১ম খণ্ড, ডব্লিউ. এ. কে. ফারমিংগার সম্পাদিত।

৭- হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া, ৫ম খণ্ড, জেমস মিল।

৮- ইংলিশ ইউটিলিটেরিয়ানস এ্যান্ড ইন্ডিয়া, এরিক স্টোকস।

৯- বাংলার ভূমি ব্যবস্থার রূপরেখা, বিনয় চৌধুরী।

১০- ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, ১ম খণ্ড, রমেশচন্দ্র দত্ত।)

 

Published by ঈশাহারা নিউজ

সত্যের পথে আপনাদের সাথে

Design a site like this with WordPress.com
শুরু করুন